রানা প্লাজার পরতে পরতে অনিয়ম

Posted by PC Help & Tricks  |  at  03:12 No comments

সাভারের আলোচিত রানা প্লাজা নির্মাণের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিয়মনীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে। ভবনটির একটি অংশ করা হয়েছে জলাশয় ভরাট করা মাটির ওপর। এটা নির্মাণ করা হয়েছে নকশা না মেনে। কাঠামো ছিল দুর্বল। নির্মাণ-উপকরণ ছিল নিম্নমানের। তিন পর্বে তিনভাবে নির্মাণ করা হয় এই ভবন। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকির অভাবের কারণেই এত সব অনিয়ম করা সম্ভব হয়েছে।
ভবনটি ধসের তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে আন্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা এশিয়ান দুর্যোগ প্রস্তুতি কেন্দ্র (এডিপিসি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ। প্রতিষ্ঠান দুটির এই অনুসন্ধানের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূরকৌশল বিভাগের পর্যবেক্ষণেরও মিল রয়েছে।
তাৎক্ষণিক মূল্যায়নে জানা গেছে, বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়। ঢাকা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) অনুযায়ী, সাভার এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করতে হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নিতে হয়। নিতে হয় পরিবেশ ছাড়পত্র। রানা প্লাজার ক্ষেত্রে এর কোনোটিই অনুসরণ করা হয়নি। নির্মাণের ক্ষেত্রে একজন স্থপতিকে দিয়ে পাঁচতলা একটি বাণিজ্যিক ভবনের নকশা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সাভার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ ওই পাঁচতলার নকশার ভিত্তিতে ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়।
ভবনটির তিন থেকে আটতলা পর্যন্ত পাঁচটি তলায় তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। ফলে সেখানে ভারী যন্ত্রপাতি ও একাধিক জেনারেটর স্থাপন করা হয়। এই ভার নেওয়ার ক্ষমতা ভবনটির ছিল না। ফলে ১০ তলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষ করার আগেই ভবনটি ভেঙে পড়ে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
ভবনধসের পরদিন থেকে কয়েক দিন সরেজমিনে এডিপিসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা পৃথকভাবে তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। অনুসন্ধান শেষ হলে তারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করবে।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহম্মদ আনসারী বুয়েটের একটি দল নিয়ে ভবনটি পর্যবেক্ষণ করেন। তাঁরা এখনো বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করেননি।
মেহেদী আহম্মদ আনসারী প্রথম আলোকে বলেন, নিয়ম না মেনে ভবন নির্মাণ করলে কী পরিণতি হতে পারে, তার আদর্শ উদাহরণ হচ্ছে রানা প্লাজা। পাঁচতলা ভবন নির্মাণের নকশা দিয়ে নয়তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল। উপকরণও ছিল নিম্নমানের। সেখানে তৈরি পোশাক কারখানার ভারী যন্ত্রপাতি ছিল। এত চাপ সহ্য করতে না পেরে ভবনটি ভেঙে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ভবনটির সামনের দিকের মূল অংশ শক্ত মাটির ওপরে ও পেছনের অংশ জলাশয় ভরাট করে করা জমির ওপরে। নিয়ম অনুযায়ী, নিচু জায়গা ভরাট করে বা নরম মাটির ওপরে ভবন নির্মাণ করতে হলে পর্যাপ্ত পাইলিং করতে হয়। রানা প্লাজার পাঁচতলার মূল নকশায় ১৮ দশমিক ৩ মিটার গভীর পর্যন্ত পাইলিং করার জন্য বলা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভবনটি নির্মাণের ক্ষেত্রে কোনো পাইলিং করা হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ও এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদের ডিন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সভাপতি মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক অংশ শক্ত মাটি, অন্য অংশ নরম মাটিতে হওয়ায় ভবনটি শুরু থেকেই ভারসাম্যহীন ছিল। তার ওপরে জেনারেটরসহ ভারী যন্ত্র চালু করলে এতে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হতো, যা নেওয়ার ক্ষমতা ভবনটির ছিল না।’
ধসের কারণ: এডিপিসির বিশেষজ্ঞ দল ধসের পরদিন ঘটনাস্থলে যায়। দলের সদস্যরা ভবনের মাটি, নির্মাণসামগ্রী, নকশাসহ আনুষঙ্গিক সবকিছু পরীক্ষা করেন।
ভবনের দেয়াল পরীক্ষা করে দেখা গেছে, নির্মাণ-উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ অনুপাত অনুসরণ করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, দেয়াল বা মেঝের মিশ্রণের অনুপাত হচ্ছে এক বস্তা সিমেন্ট, দুই বস্তা বালু ও সাড়ে তিন বস্তা সুরকি। কিন্তু ভবনের মিশ্রণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে আধা বস্তার চেয়েও কম সিমেন্ট, তিন বস্তা বালু ও তিন বস্তা সুরকি দেওয়া হয়েছে। ফলে ভবনের দেয়াল, ছাদ—সবকিছু ছিল ঝুরঝুরে।
এডিপিসির অনুসন্ধান দলের সদস্যরা জানতে পেরেছেন, ভবনটির একাধিক তলায় ভারী জেনারেটর বসানো হয়েছিল। বাণিজ্যিক ভবন হওয়ায় রাত সাড়ে আটটার মধ্যে সেখানে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যেত। ওই সময়ের পর থেকে জেনারেটরগুলো চালু করা হতো। প্রায় সারা রাত জেনারেটর চলত। একদিকে কয়েক হাজার সেলাই মেশিনের চাপ, অন্যদিকে জেনারেটরের কম্পন চলত দীর্ঘ সময়। কিন্তু এটা নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না ভবনটির। ফলে নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই ভবনটি ভেঙে পড়ে।
সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, কোনো একটি বাণিজ্যিক বা আবাসিক ভবনের তুলনায় শিল্পকারখানার ভবন দুই থেকে তিন গুণ শক্তিশালী হতে হয়।
তিন পর্যায়ে তিন ধরনের নির্মাণ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রলীগের তখনকার কর্মী (বর্তমানে যুবলীগের নেতা) সোহেল রানার বাবা মো. আবদুল খালেক ২০০৬ সালে সাভার পৌরসভার কাছে একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি চান। শুরুতে পৌরসভার প্রধান প্রকৌশলী ওই জমিতে জলাশয় থাকায় ভবন নির্মাণের অনুমতি দিতে রাজি হননি। কিন্তু পৌরসভার মেয়র বিএনপির নেতা মো. রেফাতউল্লাহ ভবন নির্মাণের অনুমতি দেন।
অনুমতি পাওয়ার পর ২০০৬ ও ২০০৭ সালে ভবনটির চারতলা পর্যন্ত মোটামুটি নকশা অনুসরণ করেই নির্মিত হয়েছিল। ২০০৮ সালের শেষের দিকে এসে সোহেল রানা নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মাণকাজ শুরু করেন। ২০১১ সালের মধ্যে ভবনটির আরও চারটি তলা নির্মিত হয়। এই তলাগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়।
দেখা গেছে, প্রথম চারতলা পর্যন্ত প্রতিটি কলামের ব্যাস ১০ বাই ১২ ইঞ্চি। এরপর ওপরের তলাগুলোতে কলামের ব্যাস কমতে থাকে। ওপরের তলায় ৭ বাই ৮ ইঞ্চি ব্যাসের কলাম দেখা গেছে। এ রকম একটি ভবনের কলামের ব্যাস ২০ বাই ২০ ইঞ্চি হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত বছর ভবনটির নবম তলা নির্মাণ শুরু হয়। এই তলাটি নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। প্রকৌশলীদের সহায়তা ছাড়া শুধু রাজমিস্ত্রিদের দিয়ে ওই তলাটি নির্মাণ করা হয়। খরচ কমাতে উপকরণের পরিমাণও কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে ভবনটির ভারসাম্য চরমভাবে নষ্ট হয়।
এডিপিসির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রানা প্লাজার আশপাশের আরও প্রায় ২০টি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে একই ধরনের অনিয়ম ঘটেছে। ওই ভবনের পেছনেই একটি জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। ফলে রানা প্লাজা যেসব ত্রুটির কারণে ধসে পড়েছে, একই রকম ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় সাভারে আরও অনেক ভবন নির্মিত হচ্ছে।
এডিপিসির নগর পরিকল্পনা ও ঝুঁকি মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ভবন নির্মাণ চলতে থাকলে ভূমিকম্প ছাড়াই আরও বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। ফলে সরকারের উচিত হবে, বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ভবন নির্মাণ-প্রক্রিয়াকে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসা।

সূত্র: প্রথম আলো

About the Author

Write admin description here..

Get Updates

Subscribe to our e-mail newsletter to receive updates.

Share This Post

Related posts

0 comments:

Latest Tweets

    Popular Posts

Tags

What they says

back to top